বলধা গার্ডেন: পুরান ঢাকার বুকে সবুজের স্বর্গ


ঢাকার ব্যস্ত জীবনযাত্রায় প্রতিদিন আমরা যেন দম বন্ধ হয়ে আসা এক কোলাহলের ভেতর দিয়ে চলতে থাকি। চারদিকে ধুলো, যানজট, শব্দদূষণ আর অনবরত মানুষের ভিড়ে অনেক সময় মনে হয় এই শহরে কোথাও আর শান্তির স্পর্শ নেই। অথচ পুরান ঢাকার অন্তরে এমন একটি জায়গা আছে, যেখানে ঢুকলেই যেন মনে হয় হঠাৎ সময় থমকে গেছে। প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্য, দুর্লভ গাছপালা আর শতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলধা গার্ডেন। পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাট এলাকায় অবস্থিত এই বাগানটি শুধু একটি সাধারণ পার্ক নয়, বরং এক অনন্য ঐতিহ্য, যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস আর সংস্কৃতি মিলেমিশে তৈরি করেছে এক স্বর্গীয় পরিবেশ।

বলধা গার্ডেনের নাম শোনার পরই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—‘বলধা’ নামটা কেন? ইতিহাস বলছে, এই উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। ১৯০৯ সালে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুর্লভ গাছপালা সংগ্রহ করে এই বাগান নির্মাণ করেন। ‘বলধা’ ছিল তাঁর জমিদারি এলাকার একটি অংশের নাম, আর সেখান থেকেই নামটি স্থায়ী হয়ে যায়। এই বাগানকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে তখন থেকেই এক ভিন্নধর্মী কৌতূহল তৈরি হয়।

ইতিহাসের আলোকে বলধা গার্ডেন

বলধা গার্ডেনের মূল আকর্ষণ কেবল এর সবুজ পরিবেশ নয়, বরং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ২০শ শতকের শুরুর দিকে নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ছিলেন উদ্ভিদপ্রেমী এক জমিদার। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ঢাকার মতো শহরে একটি বিশেষ উদ্যানের প্রয়োজন আছে যেখানে মানুষ শুধু ঘুরতে যাবে না, বরং শিক্ষা ও গবেষণার জন্যও প্রকৃতিকে জানতে পারবে। তাই তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার নানা দেশ থেকে দুর্লভ গাছপালা আমদানি করে এই উদ্যান সাজিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, এখানে প্রায় ৮০০ প্রজাতির গাছপালা একসময় সংরক্ষিত ছিল, যার মধ্যে অনেকগুলোই ছিল বিলুপ্তপ্রায় বা অতি দুর্লভ।

১৯৪০ সালে নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কিছুদিন বাগানটি অবহেলায় পড়ে থাকলেও পরবর্তীতে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আনা হয়। বর্তমানে এটি কেবল একটি ভ্রমণকেন্দ্র নয়, বরং দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত নিদর্শন।

বাগানের গঠন ও বৈশিষ্ট্য

বলধা গার্ডেন মূলত দুই ভাগে বিভক্ত:

  1. সাইকি (Psyche) – এই অংশে রয়েছে অলঙ্কারমূলক গাছ, রঙিন ফুল, শোভাবর্ধক উদ্ভিদ এবং নানা রকমের বিদেশি প্রজাতি। এখানে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে অর্কিড, গোলাপ, শাপলা, সূর্যমুখীসহ অসংখ্য ফুল। এটি মূলত বাগানের রঙিন ও নান্দনিক অংশ।
  2. সাইবেল (Cybele) – এই অংশটি মূলত ভেষজ ও ঔষধি গাছপালার ভান্ডার। এখানে আছে তুলসী, নিম, অ্যালোভেরা, মেহেদি, অশ্বগন্ধা এবং আরও অনেক ভেষজ উদ্ভিদ। ভেষজ চিকিৎসা ও উদ্ভিদবিদ্যায় যারা আগ্রহী, তাদের জন্য এটি সত্যিই এক অনন্য জায়গা।

এই দুটি অংশের সমন্বয়ে বলধা গার্ডেন যেন এক ক্ষুদ্র বনভূমি, যেখানে প্রকৃতির বৈচিত্র্য হাতের নাগালে এসে যায়।

বলধা গার্ডেনে কী কী দেখার মতো?


যদি বলধা গার্ডেনে ভ্রমণের পরিকল্পনা করো, তবে এখানে প্রবেশ করার পর একের পর এক বিস্ময় তোমাকে মুগ্ধ করবে।
  • দুর্লভ ফুল ও গাছপালা: বিদেশ থেকে আনা অনেক গাছ আজও এখানে টিকে আছে। যেমন—ক্যাকটাস, অর্কিড, ফার্ন, পাম ট্রি ইত্যাদি।
  • শাপলা পুকুর: বাগানের মাঝখানে একটি ছোট্ট জলাধার আছে, যেখানে শাপলা ফুল ফুটে থাকে। এটি ফটোগ্রাফি প্রেমীদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয়।
  • ঐতিহাসিক স্থাপনা: বাগানের ভেতরে কিছু পুরনো ভাস্কর্য ও স্থাপত্যও দেখা যায়, যা একে ভিন্ন সৌন্দর্য দিয়েছে।
  • পাখির কলকাকলি: ভোর বা বিকেলের দিকে এলে নানা প্রজাতির পাখির ডাক শোনা যায়। এটি একেবারেই ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে শহরের ভেতরে।

কীভাবে যাবেন বলধা গার্ডেন?

বলধা গার্ডেন অবস্থিত পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাট এলাকায়। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে এটি খুব কাছেই। ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে বাস, সিএনজি বা রিকশায় করে সহজেই এখানে পৌঁছানো যায়।

  • গুলিস্তান থেকেরিকশা বা সিএনজি নিলে ১৫–২০ মিনিটের পথ।
  • সদরঘাট থেকেহেঁটেও যাওয়া সম্ভব, খুব বেশি দূর নয়।
  • মিরপুর/উত্তরা থেকেগুলিস্তান পর্যন্ত বাসে এসে সেখান থেকে সিএনজি বা রিকশা নিতে হবে।

খোলার সময় ও প্রবেশ মূল্য

  • সময়: প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সরকারি ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বন্ধ থাকতে পারে।
  • টিকিট মূল্য: প্রবেশমূল্য নামমাত্র, সাধারণত ৩০ টাকা। শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সময় ছাড় দেওয়া হয়।

কেন বলধা গার্ডেনে ঘুরতে যাবেন?

ঢাকার মানুষদের কাছে বলধা গার্ডেন কেবল একটি ভ্রমণস্থল নয়, বরং এক ধরনের শান্তির আশ্রয়। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে কয়েক ঘণ্টা এখানে কাটালে মন সতেজ হয়ে ওঠে।

  • প্রকৃতি ও ইতিহাসকে একসাথে উপভোগ করার সুযোগ আছে।
  • শিশুদের নিয়ে গেলে তারা প্রকৃতি সম্পর্কে সরাসরি শিখতে পারবে।
  • ফটোগ্রাফারদের জন্য আদর্শ জায়গা।
  • শহরের ভেতরে থেকেও এক টুকরো গ্রাম্য শান্তি অনুভব করা যায়।

ভ্রমণ টিপস

  • সকালে বা বিকেলের দিকে গেলে পরিবেশ উপভোগ করা সহজ হয়।
  • ক্যামেরা বা মোবাইল চার্জ দিয়ে নিয়ে যেতে ভুলবেন না।
  • গাছপালার নাম ও বৈশিষ্ট্য জানার জন্য স্থানীয় গাইডদের সাহায্য নিতে পারেন।
  • বাগানকে নিজের বাড়ির মতোই পরিষ্কার রাখুন। কোনোভাবেই আবর্জনা ফেলবেন না।
  • পরিবারের সাথে গেলে শিশুদের সবসময় চোখে রাখুন, কারণ কিছু জায়গায় পানি বা উঁচুনিচু জমি আছে।

স্থানীয় অভিজ্ঞতা

অনেকে বলেন, বলধা গার্ডেনে প্রবেশ করার পর মনে হয় ঢাকার বাইরে চলে গেছি। এক দর্শনার্থীর মতে, “আমি ভেবেছিলাম ঢাকার ভেতরে এমন নিরিবিলি জায়গা পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু বলধা গার্ডেনে এসে সত্যিই বিস্মিত হয়েছি।”

আরেকজন লিখেছেন, “আমি মূলত ফটোগ্রাফির জন্য গিয়েছিলাম। সকালবেলা গিয়েছিলাম বলে আলো ছিল দারুণ। ফুল, পুকুর আর পুরনো স্থাপনার ছবি তুলে আমার সংগ্রহ ভরে গেছে।”

FAQ – সাধারণ প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন: বলধা গার্ডেন ঘুরতে কত সময় লাগে?
উত্তর: সাধারণত ২–৩ ঘণ্টা সময় যথেষ্ট, তবে যদি বিস্তারিতভাবে ঘুরতে চান, তাহলে আরও বেশি সময় লাগতে পারে।

প্রশ্ন: শিশুদের নিয়ে যাওয়া কি নিরাপদ?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে শিশুদের সবসময় নজরে রাখতে হবে।

প্রশ্ন: এখানে কি খাবারের দোকান আছে?
উত্তর: বাগানের ভেতরে কোনো খাবারের দোকান নেই, তবে বাইরে পুরান ঢাকার অসংখ্য রেস্টুরেন্ট আছে।

প্রশ্ন: বলধা গার্ডেন কি ফটোগ্রাফির জন্য ভালো জায়গা?
উত্তর: অবশ্যই, এটি ঢাকার অন্যতম ফটোগ্রাফি স্পট।

ঢাকা শহরের ইট-পাথর ও কোলাহলের মধ্যে যদি একটু শান্তি, ইতিহাস আর প্রকৃতির স্পর্শ পেতে চাও, তাহলে বলধা গার্ডেন হতে পারে তোমার সেরা গন্তব্য। শতবর্ষের ঐতিহ্য আর প্রকৃতির বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বাগান শুধু একটি উদ্যান নয়, বরং ঢাকার একটি অমূল্য সম্পদ। পরিবার, বন্ধু বা প্রিয়জনকে নিয়ে একদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারো এই সবুজ স্বর্গে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ