লাদাখে হঠাৎ অশান্তির পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের অভিযোগ—এই গোলমালের পেছনে রয়েছেন পরিবেশবিদ, শিক্ষাবিদ ও ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সোনম ওয়াংচুক। তাঁর সংস্থা স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (SECMOL)–এর বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই সংস্থার লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। পাশাপাশি সিবিআই তদন্তও শুরু হয়েছে।
এমনকি শোনা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় উসকানির অভিযোগে ওয়াংচুককে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। অথচ তিনি এতদিন ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে লাদাখের মানুষের স্বার্থ রক্ষার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এ প্রথম রাস্তায় নামল উত্তেজনা ও সহিংসতা।
লেহতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
লাদাখকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার দাবিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে লেহতে চারজন নিহত ও প্রায় ৮০ জন আহত হন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, সোনম ওয়াংচুক জনগণকে সহিংসতার পথে ঠেলে দিয়েছেন। যদিও তাঁর অতীত আন্দোলনে এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়দের মতে, সরকারের অবহেলা এবং অনশনরত আন্দোলনকারীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। তবে বিজেপির একাংশ অভিযোগ তুলেছে, ওয়াংচুক নাকি পাকিস্তানের সমর্থন পাচ্ছেন। কারণ তিনি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামাবাদে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্রিদ পাকিস্তান’–এ অংশ নিয়েছিলেন, যা আয়োজন করেছিল পাকিস্তানের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ডন।
ঐতিহাসিকভাবে শান্ত লাদাখ
যদিও জম্মু–কাশ্মীর দীর্ঘকাল অশান্ত, লাদাখ বরাবরই শান্তিপ্রিয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘর্ষ ছাড়া বড় কোনো সহিংসতা হয়নি। মুসলিম অধ্যুষিত কারগিল বা বৌদ্ধ অধ্যুষিত লেহ দীর্ঘদিন শান্তই থেকেছে। এমনকি ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কারগিলে স্থায়ী অশান্তি ছড়ানো যায়নি।
কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র। লাদাখের বৌদ্ধ ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় একযোগে রাজ্যের মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিলভুক্তির দাবিতে সরব হয়েছে। বৃহস্পতিবার কারগিলের জনজীবন পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে, যা আগে দেখা যায়নি।
অশান্তির সূত্রপাত: ২০১৯ সালের সিদ্ধান্ত
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু–কাশ্মীরকে বিভক্ত করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করে—জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখ। তখন লাদাখের মানুষ জম্মু–কাশ্মীরের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেয়ে খুশি হয়েছিল।
কিন্তু পরে স্বশাসন, ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তি, আলাদা লোকসভা আসন এবং পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের দাবি তুলতে থাকে স্থানীয় সংগঠনগুলো। সরকার আলোচনার জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করলেও ষষ্ঠ তফসিল নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি।
বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে ভাঙন
লাদাখ লোকসভা আসনে ২০১৪ ও ২০১৯—দু’বারই বিজেপি জয়ী হয়েছিল। তবে ২০২৪ সালে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ হানিফা জয়ী হন। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিজেপির জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় বিক্ষুব্ধ জনতা বিজেপির দলীয় কার্যালয়ে আগুন লাগায়। তাঁদের বক্তব্য—দিল্লি কখনোই লাদাখকে প্রকৃত স্বশাসন দিতে চাইছে না।
সোনম ওয়াংচুক: লাদাখের কাণ্ডারি
‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার র্যাঞ্চো চরিত্রটি বাস্তবে সোনম ওয়াংচুককে অনুপ্রাণিত করে তৈরি। ৫৯ বছর বয়সী এই শিক্ষাবিদ শুধু শিক্ষা নয়, বরং লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষায়ও সক্রিয়। তিনি পর্যটন ও শিল্পায়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং লাদাখের প্রাকৃতিক সম্পদ বেসরকারি শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন।
২০১৯ সাল থেকে তিনি লাদাখিদের দাবিগুলো নিয়ে ধারাবাহিক অনশন ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। কিন্তু সম্প্রতি পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দাবিতে নতুন অনশন শুরুর পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লেও ওয়াংচুক সহিংসতার নিন্দা করেন এবং অনশন ভেঙে দেন। তবুও সরকারের চোখে তিনি হয়ে উঠেছেন অশান্তির মূল কারণ।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
সরকার তাঁর সংস্থার লাইসেন্স বাতিল করে স্পষ্ট করে দিয়েছে, তাঁকে আর সহনশীলভাবে দেখা হবে না। বিশেষ মর্যাদা হারানো জম্মু–কাশ্মীর এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি। তার সঙ্গে যদি লাদাখও অশান্ত হয়ে ওঠে, তবে তা দেশের অখণ্ডতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
0 মন্তব্যসমূহ